রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০১:০৮ পূর্বাহ্ন

দলগুলো দ্বিধাবিভক্ত সংলাপ ইস্যুতে

দলগুলো দ্বিধাবিভক্ত সংলাপ ইস্যুতে

স্বদেশ ডেস্ক:

নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ২০ ডিসেম্বর থেকে সংলাপ করছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। এ সংলাপ কেন্দ্র করে বিভক্ত রাজনৈতিক দলগুলো। নিরপেক্ষ সরকার ইস্যুতে ঐক্য চায় বিএনপি। অন্যতম সংবিধানপ্রণেতা ড. কামাল হোসেনও ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। গণতান্ত্রিক বাম জোট সংলাপকে অর্থহীন ও কেবল আসা-যাওয়ার খেলা বলে অভিহিত করেছে। অন্যদিকে রাষ্ট্রপতির চলমান সংলাপে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের সমর্থন আছে এবং সে অনুযায়ী বেশকিছু রাজনৈতিক দল তাদের প্রস্তাব দিয়েছে। সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি পুনর্গঠনের প্রস্তাব নিয়ে সংলাপের শেষদিন ১৭ জানুয়ারি বঙ্গভবনে যাবেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ।

গতকাল সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এ মুহূর্তে জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন। দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে ঐক্য করুন। এ অবস্থায় রাজপথে নামার পরিকল্পনা কষছে সংলাপ বর্জন করা বিএনপি। চূড়ান্ত আন্দোলনে নামার আগে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ইস্যুটিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্টজনদের অভিন্ন দাবিতে পরিণত করতে চাইছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে দলটি রাষ্ট্রপতির সংলাপে অংশগ্রহণ করা ও না করা সব দলের সঙ্গেই আলোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরই মধ্যে পর্দার আড়ালে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে দলটি। সংলাপ শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে নিরপেক্ষ সরকার ইস্যুতে আলোচনায় বসবে দলটি।

এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার দাবির ফয়সালা হওয়ার পর আমাদের মূল দাবি নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থার দাবিতে আন্দোলন শুরু করব। এ দাবিতে ডান ও বামপন্থি সব রাজনৈতিক দলের বৃহৎ ঐক্য গড়ে তুলতে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করব। এরই মধ্যে বাম গণতান্ত্রিক জোটের কয়েকটি দল এবং ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে। শিগগিরই আনুষ্ঠানিক বৈঠক হবে।

অন্যদিকে, রাজনীতিতে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ শক্তিমত্তা আরও বাড়াতে ১৪-দলীয় জোটকে আরও সক্রিয়, মিত্র জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবং বেশ কিছু ইসলামী দলের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গাঢ় করার উদ্যোগ নিচ্ছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, যে কোনো ইস্যুতে বিএনপির আন্দোলনের হুমকি দেওয়ার খবর পুরনো। এবারও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ইস্যুতে নানা ধরনের কথাবার্তা বলছেন তারা। বাস্তবে সংক্ষিপ্ত সময়ে একটি আইন করা কঠিন। এমন বাস্তবতায় মহামান্য রাষ্ট্রপতি সংলাপ আহ্বান করেছেন। সেখানে অনেকের প্রস্তাবনার পাশাপাশি সংলাপ সফল করার জন্য সব রাজনৈতিক দলের সহায়তা চেয়েছেন। বাস্তবতার কথা না ভেবে আন্দোলনের ডাক দিলে জনগণ সে ডাকে সাড়া দেবে না।

বিএনপির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের আহ্বানের কথা ভেবে আওয়ামী লীগও কোনো রাজনৈতিক দলকে আহ্বান জানাবে কিনা- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ আহ্বান আমাদের সব সময়েই আছে। যে কোনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ^াসী যে কোনো প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের আওয়ামী লীগের সঙ্গে এসে রাজনীতি করার সুযোগ আছে। এই দুই দলের এমন অবস্থানের মধ্যে সংলাপে অংশগ্রহণ করা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, এ মুহূর্তে আমরা ভিন্ন কিছু ভাবছি না। যখন সময় হবে আমাদের দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলে তার পর সিদ্ধান্ত নেব।

বিএনপি নেতারা জানান, বিএনপি মনে করে জনগণের ভোটাধিকার তথা গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হলে রাজপথের দুর্বার আন্দোলন গড়া ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এ আন্দোলনে মিত্র রাজনৈতিক দল, ডান, বাম সবাইকে পাশে চান তারা। যুগপৎ অথবা একমঞ্চ যে নামেই হোক তারা নিরপেক্ষ সরকার ইস্যুতে সবার অভিন্ন কর্মসূচি চান। জামায়াত ইস্যুতে কোনো রাজনৈতিক দল এক মঞ্চে আসতে না চাইলে সংশ্লিষ্ট দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবে বিএনপি। দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, ডান বাম কোনো রাজনৈতিক শক্তিকে দূরে ঠেলে নয়; দাবি আদায়ে আলোচনার ভিত্তিতে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এবারের পথ পাড়ি দিয়ে চান তারা। দাবি আদায়ে যেখানে যে কৌশল, সেটিই প্রয়োগ করবেন তারা।

এ লক্ষ্যে বিএনপি কয়েক মাস আগে একটি রূপরেখাও তৈরি করেছে। নির্দলীয় সরকারের দাবিতে ১১ থেকে ১৩ দফার ওই রূপরেখা জাতির সামনে তুলে ধরে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেবে দলটি, যেখানে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা, খালেদা জিয়াসহ সব ‘রাজবন্দির’ মুক্তি, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন, কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটিয়ে সুশাসনের অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে।

যদিও বাম জোট বলছে, বিএনপির সঙ্গে এক মঞ্চে ওঠার সময় এখনো হয়নি। তাদের মূল আপত্তি ২০-দলীয় জোটের শরিক জামায়াতকে নিয়ে। বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক সাইফুল হক বলেন, আমাদের দাবির সঙ্গে বিএনপির দাবির মিল আছে। সে ক্ষেত্রে আন্দোলনের ঐক্য গড়ে তোলার একটি ভিত্তি আছে। কিন্তু জামায়াত বা যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান কী তা দেখতে হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, রাজনীতি চলমান। যেটি ভালো হবে সেটি করা হবে। শুধু যারা উচ্ছিষ্টভোগী তাদের তো আমরা গণতন্ত্র, জনগণ বা ভোটাধিকার আদায়ের পক্ষে দাঁড়াবে তা আশা করি না।

রাষ্ট্রপতি হামিদ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছেন ২০ ডিসেম্বর। ইসিতে নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ৩২টি দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। রাষ্ট্রপতি এখন পর্যন্ত ১৮টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ১৩ দিনে পৃথকভাবে বৈঠক করেছেন। এর মধ্যে সিপিবি, বাসদ, জেএসডি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, ইসলামী আন্দোলন ও এলডিপি আমন্ত্রণে সাড়া দেয়নি।

বর্জনকারী দলগুলোর ভাষ্য, ২০১২ ও ২০১৬ সালেও ইসি গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপ হয়েছিল। ওই দুই সংলাপে অংশ নিয়ে তারা যেসব প্রস্তাব দিয়েছিল, তার কোনোটাই মূল্যায়ন করা হয়নি। ফলে নতুন করে বলার কিছু নেই। আবার যারা সংলাপে গেছেন, সেসব দলের অনেকেই নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যু নিয়ে কথা বলেছেন।

রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদীন গণমাধ্যমকে বলেন, ১৭ জানুয়ারি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির আলোচনা শেষ হবে। এর পর সার্চ কমিটি গঠন করে দেওয়া হবে। বঙ্গভবন সূত্র বলছে, এবারের সার্চ কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া গতবারের মতোই হতে পারে। সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারককে আহ্বায়ক করে এ কমিটিতে হাইকোর্টের একজন বিচারক, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান, প্রধান হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) থাকতে পারেন। এ ছাড়া দুজন বিশিষ্ট নাগরিকও থাকবেন এই কমিটিতে, তাদের একজন হবেন নারী।

সংলাপ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত আরেক কর্মকর্তা বলেন, সংলাপ শেষে সার্চ কমিটি গঠন করা হবে। এ কমিটি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে ইসির জন্য নাম চাইতে পারে। তাদের নিজেদেরও বৈঠক করতে হবে। সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন হবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে।

এর আগেও সার্চ কমিটির মাধ্যমে ২০১২ এবং ২০১৭ সালে দুটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ওই দুটি কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে বিতর্ক আছে। এ অবস্থায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নতুন ইসি গঠনের বিষয়টি সামনে এসেছে। চলমান সংলাপের বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংবিধানের ৪৮-এর ৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া সবকিছুতেই রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অতীতে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শেই রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ভবিষ্যতেও নেবেন- এটিই স্বাভাবিক।

সংলাপ বর্জন করা বাম গণতান্ত্রিক জোট গতকাল সংবাদ সম্মেলন করেছে। এতে লিখিত বক্তব্য পেশ করেন জোটের সমন্বয়ক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। আরও বক্তব্য রাখেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম, বাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রাজেকুজ্জামান রতন, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের নেতা অধ্যাপক আবদুস সাত্তার, বাসদের (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় নেতা মানস নন্দি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, গণসংহতি আন্দোলনের বাচ্চু ভুঁইয়া, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আবদুল আলী ও ওয়ার্কার্স পার্টির (মার্কসবাদী) বিধান দাস প্রমুখ।

সাইফুল হক বলেন, ইসি পুনর্গঠনে রাষ্ট্রপতি যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তাতে প্রধানমন্ত্রী তথা সরকারি দলের তালিকা ও ইচ্ছার বাইরে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হওয়ার সুযোগ নেই। চলমান সংকটটি রাজনৈতিক। এ সংকট উত্তরণে সরকারকে অনতিবিলম্বে রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ এবং ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতৈক্যের ভিত্তিতে আইন প্রণয়নের সাংবিধানিক নির্দেশনা অনুযায়ী নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে উদ্যোগী হওয়ার দাবি জানাই। পাশাপাশি নির্বাচনের আগে সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তদারকি সরকার গঠনের জরুরি প্রশ্নেও সরকারকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় আসার দাবি জানাচ্ছি।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877